অর্ধ প্রজাপতি : প্রতিস্পন্দ ও শূন্যতার ব্যাকরণ
মুনশি আলিম
নন্দিতা ভৌমিক একজন দীপ্তিমান কবি। যাঁর শৈল্পিক আলোকছটা ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলা কাব্যাঙ্গনে। তাঁর অর্ধ প্রজাপতি একটি নিটোল কাব্য। যে কাব্যের পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রেম, একাকিত্ব, স্বপ্নভঙ্গ এবং অপূর্ণতার ভাবাবেগ। কবি অত্যন্ত যত্ন সহকারে এই কাব্যটির শিল্পশৈলি বিনির্মাণের চেষ্টা করেছেন। চার ফর্মার এই কাব্যটি ২০২৫ সালে বইকুঞ্জ থেকে প্রকাশিত হয়। এতে মোট কবিতা রয়েছে ৫০টি। পুরো কাব্যটির শরীরজুড়ে রয়েছে সমকালীন বাস্তবতার প্রচ্ছদপটে মোড়ানো অপূর্ণ প্রেমের রোদন।
নন্দিতা ভৌমিকেরঅর্ধ প্রজাপতি কাব্য এক গভীর অনুভূতির প্রতিস্পন্দন। কবিতাগুলো ভাষাগত সৌকর্য ও চিত্রকল্পের মাধ্যমে জীবনের অন্তর্নিহিত অপূর্ণতার বেদনাকে প্রকাশ করেছে; যা পাঠককে গভীরভাবে নাড়া দেয়। ‘অর্ধ’ শব্দটি জীবনের অসম্পূর্ণতাকে বোঝায়, যেখানেঅর্ধ প্রজাপতি স্বাধীনতা ও সৌন্দর্যের প্রতীক। কিন্তু একটি অর্ধেক প্রজাপতি উড়তে পারে না—এই দ্বৈততাই এই কাব্যের মর্মবস্তু। তাঁর কাব্যে ভালোবাসা ও আবেগ, স্বপ্ন ও আশা, দুঃখ ও বেদনা, জীবন ও প্রকৃতি, আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান, প্রেম ও আবেগ, ব্যথা ও যন্ত্রণা, ঐতিহ্য ও প্রকৃতি, যুদ্ধ ও প্রতিবাদ, ঐক্য ও একতার অনুভূতির স্বতস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর কাব্যের চিত্রকল্পগুলো যেনো কাব্যশরীর লেপটে থাকে—
ওরে মেঘ! বল, কাহার ধ্বনি শুনি তব বুকে?
কিসের ব্যথায় ঝরাও জল এই নিশীথের বুকে?
বজ্র কিসের? কাহার কান্না? কাহার অশ্রুজল?
কোন বিধাতা, কোন প্রণয়ী দিল শাপে গল?
অনেক কবিতায় প্রেমের অনুভূতি এবং তা নিয়ে আবেগের প্রকাশ দেখা যায়। যেমন—’ঘুম আসে না’ কবিতায় প্রেমের অনুভূতি গভীরভাবে ফুটে উঠেছে, যেখানে প্রেমিকের মধ্যে প্রেমের চিন্তা ও অনুভূতি ঘুমের মতো অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি করে। একইভাবে, ‘প্রেম ও ত্যাগ’ ও ‘প্রেমের বিদ্রোহ’ কবিতায় প্রেমের বাস্তবতা, ত্যাগ এবং বিদ্রোহী অনুভূতি তুলে ধরা হয়েছে। কবিতাগুলোর মধ্যে ব্যথা, দুঃখ এবং যন্ত্রণা কেন্দ্রীয় স্থান পেয়েছে। কবি জীবনকে দেখেছেন, বাস্তবতাকে দেখেছেন নিজের মতো করে। তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে শ্রমজীবী মানুষের জয়গান। তাঁর কবিতায় স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে দুঃখের মধ্যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ।
ওরে মাটির পুত্র, শোন রে ভাই- শ্রমের ইতিহাস!
রক্ত-ঘামে ভেজা এ দেহখানি, ক্ষুধার নির্বাস!
জীবনের ভার বহি রোজ সকালে পথের ধুলায় লুটে,
তবুও মুখে হাসি, বুকে জ্বালা- চোখে অশ্রুর ফোঁটা ফুটে!
কিছু কবিতায় প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক এবং ঐতিহ্যগত চিন্তা দেখা যায়, যেমন—’নদীর কূলে ফুলকি’ কবিতায় নদী ও গ্রাম্য জীবন এবং তাদের গভীর সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ‘প্রেমের বিদ্রোহ’ এবং ‘দুঃখের আগুনে’ কবিতায় বিদ্রোহ এবং সংগ্রামের অনুভূতি প্রকাশ পায়; যা প্রেমের অগ্নিশিখা এবং দুঃখের মধ্যে প্রতিবাদী মানসিকতা ধারণ করে। ‘নদীর পাশে গ্রাম’ কবিতায় নদীর প্রতীক হিসাবে জীবনের পথে চলতে থাকা একক যাত্রার অনুভূতি এবং মানুষের একাত্মতার অনুভূতি ফুটে উঠেছে। এছাড়া কবিতাগুলির মধ্যে সৃষ্টিশীলতার, অস্তিত্বের প্রশ্ন এবং মানবিক বোধের গভীরতা ফুটে উঠেছে; যা পাঠককে চিন্তা করতে বাধ্য করে।
অর্ধ প্রজাপতি কাব্যের বেশিরভাগ কবিতাই প্রেম এবং ভালোবাসার উপর ভিত্তি করে লেখা। সম্পর্কের গভীরতা, ত্যাগ, আবেগ এবং মনের অবস্থাগুলির নানা দিক প্রকাশিত হয়েছে। কবি তাঁর অনুভূতি প্রকাশে শাসিত বা উদ্বিগ্ন। যেমন— ‘তুমি আমার রাজকুমারী,’ ‘তুমি এই শহরে নেই,’ বা ‘বিচিত্র জীবন।’ কিছু কবিতায় জীবনের গভীরতা ও খুঁজে পাওয়া স্বপ্নের কথা উঠে এসেছে। কবি স্বপ্ন সঙ্গী,’ ‘ভালোবাসার চাদর’ কবিতায় জীবনের সংগ্রাম, আশা, প্রেমের পূর্ণতা এবং তাদের বিশ্বাসকে তুলে ধরেছেন।
‘পোড়া মন’ ও ‘ভবসাগর’ কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে জীবনের কষ্ট ও বেদনার অভিজ্ঞতা। কবি একাধিক ক্ষেত্রে দুঃখ-কষ্টের অভিজ্ঞতা এবং তার থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছেন। প্রকৃতি, ঋতু পরিবর্তন এবং জীবনের মিথস্ক্রিয়া কবিতায় নানা দৃষ্টিকোণ থেকে এসেছে। যেমন— ‘ফাগুন সমীরণে,’ ‘নববসন্ত,’ বা ‘নীল রঙের পাখি,’ যেখানে জীবনের সৌন্দর্য এবং তার বিভিন্ন রূপ ফুটে উঠেছে। কিছু কবিতায় নিজের প্রতি বিশ্বাস এবং আত্মবিশ্বাসের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন— ‘প্রেমের হিস্ট্রি’ এবং ‘স্বপ্নময় বাসর’।
কিছু কবিতায় প্রকৃতি ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা দেখা গেছে। যেমন— ‘ভাষাকে ভালোবাসো’। এখানে কবি বাংলা ভাষা, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। ‘হৃদয়ের জংশন’, ‘দেহ ঘড়ি’ এবং ‘বিচিত্র জীবন’ কবিতাগুলিতে সম্পর্কের জটিলতা, দিশাহারা মন এবং কখনও কখনও ভুল বোঝাবুঝির কথা উঠে এসেছে। ভালোবাসার অপূর্ণতাই তাঁর কাব্যে ঘুরেফিরে এসেছে। যেখানে রয়েছে চমৎকার ভাষার সরলীকরণ।
আমার হৃদয় যদি শিউলির ফুল হতো,
কুড়াবে তুমি তাই অঝোরে ঝরে যেত।
আমার এ মন যদি আকাশের মেঘ হতো,
পথের সাথী হয়ে তোমায় ছায়া দিতো ৷৷
নন্দিতা ভৌমিকের কবিতার ভাষা সংবেদনশীল ও গভীর অর্থবহ। মুক্তছন্দ ও অন্ত্যমিলযুক্ত ছন্দের অপূর্ব মিশ্রণ এই কাব্যকে পাঠযোগ্য করে তুলেছে। যদিও কিছু কবিতায় ধ্বনিগত বৈচিত্র্য ও শব্দের পুনরাবৃত্তি আবেগের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। তাঁর কবিতাগুলো ব্যক্তিগত অনুভূতির গভীর প্রতিফলন; যা পাঠকের হৃদয়ে নাড়া দেয়। অর্ধ প্রজাপতি নামের মতোই, পুরো কাব্যে অপূর্ণতা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীকী ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। কবিতাগুলোর শব্দচয়ন ও বাক্যগঠনে আবেগের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটে।
শব্দই হলো অমোঘ অস্ত্র। শব্দকেই বলা হয় শব্দব্রহ্ম বা ব্রহ্মাস্ত্র! আর এই শব্দ দিয়ে কবি একের পর এক অঙ্কন করেছেন বোধের মহাবিশ্ব। সমকালীন বাস্তবতা, জীবনের জটিলতা, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির গ্রন্থি মোচন, চিন্তাচেতনার ঋদ্ধতা এমনকি শুদ্ধতার স্বর অনুক্রমিকভাবেই তাঁর কাব্যশরীরের লেপটে রয়েছে। কবির ভাষার গভীরতা ও বিমূর্ততা একাধারে সংবেদনশীল ও রূপকার্থ বহনকারী। তার কাব্যের চিত্রকল্পগুলো ভাবনার অবকাশ রাখে। যেমন—
তোমার চাহনি, তলোয়ার সম/ মেঘ, ওরে মেঘ! বলো তুমি দুঃখ-সাগরের গান
কাব্যের বেশিরভাগ কবিতা মুক্তছন্দে রচিত হলেও কিছু ক্ষেত্রে অন্ত্যমিল ও ধ্বনিগত পুনরাবৃত্তির সাহায্যে ছন্দময়তা সৃষ্টি করা হয়েছে—
ঘুম আসে না, আসে না ঘুম
এই বাক্যে ধ্বনি পুনরাবৃত্তি ও ছন্দের সংমিশ্রণে কাব্যিক সুর সৃষ্টি হয়েছে।
কবিতাগুলোতে ব্যক্তির মানসিক জগতের টানাপোড়েন, আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব ও স্মৃতি-বিস্মরণের মিশ্র অনুভূতি চিত্রিত হয়েছে। এই কাব্যে প্রকৃতি, অনুভূতি ও জীবনধারার সঙ্গে জটিল রূপক ও চিত্রকল্পের সংমিশ্রণ রয়েছে। তবে অনেক কবিতায় শব্দের পুনরাবৃত্তি ও অস্পষ্ট উপমা ব্যবহার করা হয়েছে; যা ভাষার সরলতা ও প্রবাহকে ব্যাহত করতে পারে।
কবিতায় ভাষা চয়নের ক্ষেত্রেও তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে। বিশেষ করে ভাষার সরলীকরণ এই কাব্যের মাহাত্ম্যকে অনেকটাই বেগবান করেছে। যথাসম্ভব সরল বাক্যের পথ ধরেই তিনি হেঁটেছেন। এদিক বিবেচনায় নিঃসন্দেহে তিনি প্রশংসার দাবিদার। এই কাব্যের প্রকৃত রসদ পেতে হলে পাঠককে অবশ্যই মূলবই ধরেই এগোতে হবে। কবিতার চিত্রকল্পের বুনো বাগান ধরেই হাঁটতে হবে।
তাঁর কাব্যে মানবজীবনকে দেখা হয়েছে বিচিত্ররূপে। জীবনকে তুলনা করা হয়েছে প্রবহমান নদীর সাথে। নদীর শেষ কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মধু বুঝতে পারে—জীবন এবং নদীর গন্তব্য কখনোই নির্দিষ্ট নয়। তাঁর কবিতায় জীবনকে এক অন্তহীন যাত্রা হিসেবে দেখানো হয়েছে; যেখানে উত্তর বাহিরে নয় বরং অন্তর্নিহিত।
অর্ধ প্রজাপতি নামটি কেবল একটি শিরোনাম নয়, এটি কাব্যের মূল ভাব, দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রতীকী ব্যঞ্জনা এবং নান্দনিকতার এক চমৎকার সমন্বয়। এটি অপূর্ণতার যন্ত্রণা, আকাঙ্ক্ষার দ্বৈততা এবং জীবনের অসম্পূর্ণতার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। নামটি কাব্যের সার্বিক ভাবনাকে যথাযথভাবে তুলে ধরেছে। কবিঅর্ধ প্রজাপতি কাব্যে প্রকৃতির সাথে মানব-অস্তিত্বের গভীর সংযোগ এবং চিরন্তন প্রেমের ধারণা শব্দশিল্পের মধ্যে লেপটে দিয়েছেন। কাব্যভাষায়—
তোমার চোখের নদীতে ভাসি আমি নিরবধি/
তুমি ছুঁয়ে গেলে হৃদয়ের গহীন গুহায়
কাব্যটিতে জীবনের অমীমাংসিত রূপ এবং শূন্যতার ভাব অবলীলায় ধরা পড়ে। কবি দ্বৈততা এবং অসম্পূর্ণতাকে এক ধরনের রূপকল্পে পরিণত করেছেন। ‘অর্ধ’ ও ‘প্রজাপতি’ শব্দ দুটি একে অপরের বিপরীতার্থক। একদিকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে অপূর্ণতার বেদনা। এটি জীবন ও সম্পর্কের দ্বৈততাকেও প্রকাশ করে।
অর্ধ প্রজাপতি কাব্যে নন্দিতা ভৌমিক অপূর্ণতার শৈল্পিক রূপ তুলে ধরেছেন। প্রতিস্পন্দ ও শূন্যতার ব্যাকরণ এক নতুন কাব্যিক ভাষা নির্মাণ করেছে; যা পাঠককে ভাবায় এবং গভীর অনুভূতিতে আবিষ্ট করে।
অর্ধ প্রজাপতি শুধু প্রেমের কাব্য নয়, এটি জীবনের এক অন্তর্দর্শন। প্রেম, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা এবং দুঃখবোধ—এই অনুভূতিগুলোর নিপুণ সংমিশ্রণে এটি বাংলা কবিতার আধুনিক ধারার একটি উজ্জ্বল সংযোজন। কাব্যপ্রেমী পাঠকের জন্য এটি এক আবেগঘন পাঠযাত্রা। কবি নন্দিতা ভৌমিক-এর ‘অর্ধ প্রজাপতি’ কাব্যটির সবগুলো কবিতাতেই পাঠক অমিয় রসে সিক্ত হবে, ভাবাবেগে আহ্লাদিত হবে। এককথায়, কবিতাগুলো পাঠকমনে নিঃসন্দেহে চিন্তার উদ্রেক ঘটাবে বলেই আমার বিশ্বাস।