মানব বনসাই : শিশুদের নির্মল বিনোদন ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সেরা সূতিকাগার

মানব বনসাই : শিশুদের নির্মল বিনোদন ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সেরা সূতিকাগার

মুনশি আলিম

 

‘বনসাই’ শব্দটির সঙ্গে আমরা কমবেশি সকলেই পরিচিত। কিন্তু মানব বনসাই? সত্যিই নামকরণটি একটু ভিন্নরকম। খুব সম্ভব বাংলা শিশুতোষ গল্প কিংবা কথাসাহিত্যে গল্পকার জসীম আল ফাহিমই এর সফল এবং সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এই শিশুতোষ গল্পগ্রন্থটি সিলেটের ‘শ্রীহট্ট প্রকাশ’ থেকে ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়। প্রচ্ছদ করেছেন মুনশী ইকবাল। চার ফর্মার এই বইটিতে মোট ১৬টি গল্প রয়েছে। সবগুলো গল্পেরই অসাধারণ অলংকরণ করেছেন টিটন কান্তি দাশ।

 

বইয়ের উল্লিখিত গল্পগুলো হলো-গাছ, কাঁকড়া, হায়েনা, দিনমজুর, পাকা আম, অমানবিক, রাজফকির, ফুলপ্রেমিক, টেপার কাণ্ড, ডুমুরের ফুল, মানব বনসাই, গাধা ও ঘোড়া, ফুল ফোটানো, মাকড়শার জাল, শিয়াল ও শেয়ালি, টুনুর জন্য অপেক্ষা প্রভৃতি।

 

বই প্রকাশের আগে একজন প্রকাশক কিংবা গল্পকারকে প্রথমে মাথায় রাখতে হয় শিশু-কিশোরদের বয়স। তার মানে হলো বয়সের ওপর নির্ভর করেই গল্পের প্লট, বিষয়-শৈলী, বিন্যাস, প্রকরণ থেকে শুরু করে যাবতীয় নির্মাণশৈলী পরিবর্তিত হয়। এর পরের অংশ আরও কঠিন এবং জটিল। সেটা হলো গল্পবই প্রকাশের আগে গল্প সিলেকশন। বাংলাদেশের অধিকাংশ শিশুতোষ গল্পকারগণই এ জায়গাতে এসে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। জসীম আল ফাহিমের ‘মানব বনসাই’ গ্রন্থের গল্প নিয়ে হয়ত কোনো প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন বা বিতর্ক দেখা দেয় গল্পের সিলেশনে এসে। এই গ্রন্থের সবগুলো গল্পই শিশুকিশোর উপযোগী নয়।

 

‘মানব বনসাই’ গ্রন্থের প্রথম গল্পটির নাম ‘গাছ’। গল্পটিতে মোরাল রয়েছে। তবে আপত্তি অন্য জায়গায়। একজন গল্পকারকে সচেতনভাবেই মাথায় রাখতে হবে যে, শিশুদের মনে নির্মল আনন্দ ছাড়া কোনোরূপ কষ্ট দেওয়া যাবে না। ভায়োলেন্স সৃষ্টি করে এমন প্লট বা কাহিনি থেকে গল্পকারকে সরে আসতে হবে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এরকম থিম থেকেও সরে আসতে হবে। এই গ্রন্থের হায়েনা, অমানবিক, শিয়াল ও শেয়ালি, টুনুর জন্য অপেক্ষা প্রভৃতি গল্পগুলোতে শিল্পশৈলী অক্ষুণ্ন থাকলেও নেতিবাচক প্রভাবের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ।

 

বয়সভেদে গল্প নির্বাচন ভুল হলে তার প্রভাব পাঠকপর্যায়ে গিয়েও পড়ে। এই গ্রন্থটিতে শিশু উপযোগী কিছু ভুল গল্প নির্বাচন করা হয়েছে। মূলত এসব গল্পগুলো বড়োদের উপযোগী। যেমন-কাঁকড়া, রাজফকির, ফুলপ্রেমিক, টেপার কাণ্ড, ডুমুরের ফুল প্রভৃতি। ছোটোখাটো এসব ত্রæটি সত্তে¡ও গল্পগ্রন্থটি এককথায় অসাধারণ। এই জন্যই অসাধরাণ যে, এর ভাষাশৈলী খুবই চমৎকার। বিশেষ করে শিশু উপযোগী ভাষা। এককথায়, গ্রন্থটির ভাষার সরলীকরণ সত্যিকার অর্থেই এই গ্রন্থটিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

 

গল্পে সংলাপের যুতসই ব্যবহারে গল্পগ্রন্থটি পেয়েছে ভিন্নধর্মী ব্যঞ্জনা। এছাড়া তাঁর প্রতিটি গল্পেই রয়েছে মোরাল। অর্থাৎ গল্প থেকে নৈতিক শিক্ষা। তাঁর গল্পপাঠে শিশু-কিশোররা কখনোই বিরক্তবোধ করবে না। কেননা, তাঁর গল্প বুনন বা গল্প বলা কৌশল এতই নিপুণ যে, শিশুকিশোর মাত্রই তাঁর গল্পে বুঁদ হয়ে থাকবে।

 

‘মানব বনসাই’ গ্রন্থের ‘গাছ’ গল্পের রবি, ‘কাঁকড়া’ গল্পের শমসের আলী, ‘হায়েনা’ গল্পের স্বামী বা স্ত্রী হায়েনা, ‘দিনমজুর’ গল্পের কৃষক, ‘পাকা আম’ গল্পের খুকি, ‘অমানবিক’ গল্পের কবুতর, ‘রাজফকির’ গল্পের রাজফকির, ‘ফুলপ্রেমিক’ গল্পের রহিম সাহেব,  ‘টেপার কাণ্ড’ গল্পের টেপা ও তার বউ, ‘ডুমুরের ফুল’ গল্পের জনৈক ফকির, ‘মানব বনসাই’ গল্পের বটগাছ ও মালি, ‘গাধা ও ঘোড়া’ গল্পের তোবারক আলী, ‘ফুল ফোটানো’ গল্পের পাখি ও বীজ,  ‘মাকড়শাল জাল’ গল্পের পিয়াস ও মাকড়শা, ‘শিয়াল ও শেয়ালি’ গল্পের শিয়াল-শেয়ালি, ‘টুনুর জন্য অপেক্ষা’ গল্পের মারজান ও টুকু কুকুর অসাধারণ শিল্প মহিমায় জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে।

 

তবে এটাও বলে রাখি, এই গল্পগ্রন্থের প্রকৃত রসদ পেতে হলে পাঠককে অবশ্যই মূলবই ধরে এগোতে হবে। জসীম আল ফাহিমের বনসাই গল্পগ্রন্থের সবগুলো গল্পই শিশুকিশোরদের চিন্তার উদ্রেক ঘটাবে বলেই আমার বিশ্বাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *