সর্দার ব্যাঙ – মুনশি আলিম

সর্দার ব্যাঙ (শিশুতোষ ছোটগল্প )

মুনশি আলিম

 

এক
কুসুমপুর এলাকা জুড়ে বেশ কয়েকটি ছোটবড় পুকুর আছে। সবচেয়ে বড় পুকুরের নাম ‘ঠনঠনি’ পুকুর। এই পুকুরেই বাস করত ‘টিউটিউ’ ব্যাঙেরা। ‘ঠনঠনি’ নামটি অবশ্য পুকুরের মালিক অরবিন্দ তালুকদার রাখে নি, রেখেছে এলাকার দুষ্টু যুবকেরা। এই নামকরণের নেপথ্যে কারণও আছে। সে অনেক দিন আগের কথা। তখন এই এলাকার মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার চেয়ে ধনী ব্যক্তি। এলাকার সকল অনুষ্ঠানেই তিনি প্রধান অতিথি থাকার চেষ্টা করতেন, কিন্তু কোন অনুষ্ঠানেই তিনি কোন প্রকার চাঁদা-টাদা দিতেন না। তিনি এমনই কঞ্জুস ছিলেন যে- ভিক্ষুক, হত দরিদ্র কিংবা প্রতিবন্দীদের কল্যাণেও কখনো দুই চার টাকা খরচ করেছেন বলে শোনা যায় নি। নিজে সব সুবিধাই নিবে অথচ অন্যের বেলায় তিনি ঠনঠন বলে এলাকার দুষ্টু যুবকেরা তার নামকরই করে ফেলেছে ‘ঠনঠনি তালুকদার’। আর সে নামকরণের সূত্র ধরেই তার পুকুরের নামও রাখা হয়েছে ‘ঠনঠনি’ পুকুর!

এই পুকুর আয়তনে ছিল বেশ বড়। দীর্ঘকাল ধরে অযত্ন আর অবহেলায় এই পুকুর শেওলা আর কুচুরিপানায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। এই পুকুরেরই উত্তর দিকে বাস করত ’টিউটিউ’ ব্যাঙেরা। এরা যখন পুকুরে সাঁতার কাটত, তখন সকলেই একসাথে সাঁতার কাটত; আবার যখন ডাকাডাকি শুরু করত তখন সকলেই একসাথে ডাকত। তাদের সবার সাথেই ছিল গলায় গলায় ভাব। অরবিন্দ তালুকদার অন্যের বিপদে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে না এলেও তারা কিন্তু একে অপরের বিপদে নিজের জীবন কুরবানি করতেও দ্বিধাবোধ করে না!

সেদিন ছিল খুব বৃষ্টি। টিউটিউ ব্যাঙের সর্দার গঞ্জ থেকে মাত্রই ফিরে এসেছে। সর্দারের আসার খবর শুনেই বাচ্চা ব্যাঙাচিরা লেংটি পড়ে দলবেঁধে এসেছে। মৃদু স্বরে সর্দারের স্তব মূলক ব্যাঙ্গীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত পরিবেশন করতে থাকে। সর্দার তো বুঝে ফেললেন বাচ্চারা কী চাচ্ছে। এরপর আর দেরি করলেন না। নিজের ঝুলা থেকে গঞ্জ থেকে আনা মিষ্টি বের করে দিলেন। গঞ্জের মিষ্টি পেয়ে তারা খুশিতে বাকবাকুম করতে করতে চলে গেল।

অরবিন্দের ছেলে টুকুর সাথে সর্দার ব্যাঙের ছিল বেশ ভাব। টুকু সর্দার ব্যাঙকে কাছে ডাকতেই সে তার কাছে ছুটে যেত। তারপর দুজনে ইচ্ছে মতো খেলত। টুকু আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই সর্দারকে বলল- সর্দার কাল আমার জন্মদিন। তোমার সকল সদস্যদের নিমন্ত্রণ রইল। সর্দার তো মহা খুশি। খুশিতে কয়েক লাফেই চলে গেল নিজের বাড়িতে। ছোট-বড় সকলকেই ডেকে জড়ো করে বললেন- কাল আমার দুপেয়ে বন্ধু টুকুর জন্মদিন। সেখানে তোমাদের সকলের নিমন্ত্রণ। ভাল ভাল কাপড়-চোপড় পড়ে তোমরা সেখানে যাবে। সেই সাথে ছোট ব্যাঙাচিদের সাবধান করে দিলেন- যাতে করে কেউ সেখানে ল্যাঙটা হয়ে না যায়!

দুই
পরদিন। সকালবেলা। ব্যাঙ রমণীরা সেই সকাল থেকেই সাজগোজ শুরু করেছে। সর্দারের বন্ধুর জন্মদিন বলে কথা! একটু সাজগোজ না করে গেলেই যে নয়! অবিবাহিত তরুণী ব্যাঙেরা সেই যে সাত সকালে পার্লারে সাজগোজের জন্য বেরিয়েছে দুপুর হয়ে এল এখনো আসার নামগন্ধও নেই। সর্দার ব্যাঙ বিকেল ৪ টার সময় সবাইকে জারুল তলায় একত্রিত হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। যেই কথা সেই কাজ। যথাসময়ে সকলেই হাজির হল।

ব্যাঙ সর্দার মহাসমারোহে বন্ধুর জন্মদিনে দাওয়াত খেতে চললেন। কিছুদূর যাওয়ার পর তারা হিজল তলায় বসে একটু জিরিয়ে নিল। মূলত প্রবীণ ব্যাঙেরা একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য আবদার করেছিল। সর্দার বলে তাকে অনেক কিছুই মানতে হয়, বুঝতে হয়, বিবেচনা করতে হয়। অবশ্য সর্দার হিসেবে তার সেরকম সকল গুণই ছিল। টিউটিউ গোত্রভূক্ত সকল ব্যাঙই তাকে শ্রেষ্ঠ সর্দার হিসেবে মানত।

তারা যেখানে বিশ্রাম নিচ্ছিল তার একটু দূরেই টুকুর বাড়ি। বাড়িতে বেশ সাজসাজ রব। দলবেঁধে দুপেয়ে দৈত্যরা বাড়ির ভিতর প্রবেশ করছে। সর্দারের অবশ্য বাড়ির ভিতরে যাওয়ার অনুমতি নেই। তাদের নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে শান বাঁধানো পুকুর ঘাটের দক্ষিণ ভিটিতে।

একটু পর সব টিউটিউ ব্যাঙেরা পুকুর ঘাটের দক্ষিণ ভিটিতে উপস্থিত হল। ব্যাঙাচিদের ততক্ষণে ক্ষুধায় যেন পেট চুচু করা শুরু করেছে। তাদের যেন আর তর সইছে না। সবাই সর্দার ব্যাঙকে বলতে লাগলো- সর্দার, আর কত দেরি?

সবার চাপে পড়ে সর্দার লাফাতে লাফাতে বন্ধু টুকুর বাড়ির রাস্তায় গেল। যাওয়া মাত্রই দেখল টুকু আকাশের মত বড় বাটিতে করে যেন কী আনছে! টুকু সর্দারের সাথে কুশল বিনিময় করলো। তার সাথে হ্যান্ডসেকও করল।
টুকুর পাশেই ছিল তার আরেক বন্ধু জিকু। সে ছিল খুবই দুষ্টু। ব্যাঙদের দুই চক্ষে দেখতে পারতো না। টুকু ব্যাঙের সাথে হ্যান্ডসেক করেছে দেখে ঘৃণায় তার শরীর ঘিন ঘিন করছে। বন্ধুকে শিক্ষা না দিতে পারলেও ব্যাঙকে একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া চাই-ই চাই। সে নিজের মধ্যে কি যেন একটা ফন্দি আঁটলো।

ব্যাঙের পথ ধরে টুকু ও জিকু দুজনেই গেল পুকুর ঘাটের দক্ষিণ ভিটিতে। সেখানে যাওয়া মাত্রই জিকুর চোখ যেন কপালে ওঠার মত অবস্থা। পুকুর ঘাটের দক্ষিণ ভিটি ছোটবড় কয়েক হাজার ব্যাঙে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। একসাথে এত ব্যাঙের উপস্থিতি তার জীবনেও দেখে নি। তাছাড়া টুকু ব্যাঙের সাথে বন্ধুত্ব রাখুক এটা সে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু তার মনের এই গোপন কথাটুকু সে প্রকাশ করল না। কেবল মনে মনে একটা দুরভিসন্ধি আঁটলো।

জিকুর হাতে অনেকগুলো গ্যাসের বেলুন ছিল। সেগুলো দেখতেও ছিল বেশ চকচকে। পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের আলোয় সে বেলুনগুলো যেন আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেছে। মুখে বেশ প্রসন্নতা ভাব এনে জিকু সর্দারকে বলল- এই বেলুনগুলো নিয়ে টুকুকে আশীর্বাদ কর। সাথে সাথে তোমার সদস্যদেরকেও বলো আশীর্বাদ করতে। কী বলে আশীর্বাদ করতে হবে তাও বলে দিল সে। “হ্যাপি বার্থ ডে টুকু”। ইংরেজি শব্দ শুনে সব ব্যাঙেরা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো। জিকু বুঝতে পারলো ইংরেজি তাদের মোটেও পছন্দনীয় নয়। এতে করে তার রাগের পরিমাণ আরও বেড়ে গেল, কিন্তু তা প্রকাশ করল না। তখন সে আরেকটু কৌশলী কণ্ঠে বলল- বল – “শুভ জন্মদিন টুকু”। এবার সব ব্যাঙ নড়েচড়ে বসল। সবাই সর্দারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সর্দার বলার সাথে সাথেই তারাও বলবে।

জিকু সর্দার ব্যাঙের হাতে বিশটি গ্যাস বেলুনের একত্রিত করা সুতা এগিয়ে দেয়। সর্দার ব্যাঙ সুতা ধরতেই জিকু বলে- দুহাত দিয়ে শক্ত করে ধর। সর্দার ব্যাঙ সরল চিত্তে তাই করলো। যেই না মাত্র সর্দার ব্যাঙ সুতাটি ধরেছে অমনিই বেলুনগুলো সর্দারকে নিয়ে আকাশের দিকে দিল ছুট। প্রথম দিকে সর্দার একটু আনন্দ পেলেও কিছুটা উপড়ে উঠতেই তার মুখ ভয়ে পাংশুটে হয়ে গেল। সর্দার ব্যাঙ সুতা ছাড়তে খুব চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। সুতার মধ্যে খুব আঁঠালো জাতীয় কী যেন দেওয়া! এদিকে জিকু সব ব্যাঙদের বলতে থাকে- দ্যাখ, তোমাদের সর্দার জাদু জানে! জাদু বলে আকাশে ওড়ছে! উড়তে উড়তে সে স্বর্গের দিকে যাবে। প্রথম প্রথম সব ব্যাঙই বিশ্বাস করল। কিন্তু যতই সে উপরে উঠতে থাকে ততই যেন তারা ভয় পেতে থাকে। সর্দার ব্যাঙ উপর থেকে চিৎকার করতে থাকে। বাঁচাও! বাঁচাও!! বাঁচাও!!! তা শুনে জিকুর সেকি অট্টহাসি!

টুকু তার বাটির খাবারের তালা খুলতে খুলতেই এই কাণ্ডটি ঘটেছে। সর্দারের চিঁকার শুনে সে বাটি ফেলেই সে বেলুনটি ধরার জন্য লাফ দেয়। কিন্তু ততক্ষণে বেলুনসহ সর্দার ব্যাঙ অনেক উপরে ওঠে গেছে। ঠিকানাহীন উড়ন্ত সর্দারের দিকে তাকিয়ে টুকুর চোখ ছলছল করে ওঠে। কান্নাজড়িত অস্পষ্ট স্বরে বলে- মাফ করো বন্ধু, যেখানেই যাও, ভাল থেকো, ভালো থেকো।

———————-
১৫.১১.২০১৪
মুনশি আলিম
জাফলং, সিলেট

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *