সাহস, সেবা ও সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি: গিয়াস উদ্দিন
অণুলিখন-মুনশি আলিম
মো. গিয়াস উদ্দিন এক আলোকিত মানুষ। দেশপ্রেম আর মানবসেবাই যাঁর জীবনের পরমব্রত। তিনি একাধারে ডাক্তার, বিচারক, সমাজসেবী, সংগঠক, গায়ক, সুবক্তা, রাজনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা প্রভৃতি বহু গুণে গুণান্বিত। এই গুণী মানুষ ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি জকিগঞ্জ উপজেলার মানিকপুরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাল্লাহ্ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শহিদ ডাক্তার মো. আ. রহিম এবং মাতা জহুরা বেগম। ছয় ভাইবোনের মধ্যে ডাক্তার মো. গিয়াস উদ্দিন তৃতীয়।
শৈশবে মা-বাবা উভয়ের কাছে তিনি ছিলেন খুবই আদরের। কোনোকিছু আবদার করামাত্র মা-বাবাসহ পরিবারের জ্যেষ্ঠ সকলেই তা পূরণ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে যেতেন। কৃতিত্বের সঙ্গে পাঠশালা শেষ করে ভর্তি হলেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এসএসসি পরীক্ষার সময়ই দেশে যুদ্ধ শুরু হয়। পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার কারণে তাঁর পক্ষে আর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভবপর হয়নি। চারদিকে অসংখ্য মানুষের আহাজারি দেখে তিনি স্থির করলেন যুদ্ধে যাবেন। যে কথা সেই কাজ। মা-বাবাকে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তাব করতেই তাঁরা সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। শুধু রাজিই নয় বরং তাঁর সঙ্গে অপর দুই ভাইদেরও যুদ্ধে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন; যাতে কিশোর গিয়াস উদ্দিন ভয়ে পিছু না হটে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বড়ো ভাই আবদুস সালাম, জালাল উদ্দিনসহ তাঁরা মোট তিনজন একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অসমসাহসী মুক্তিযোদ্ধা।
জালালপুরের সাব-সেক্টর কমান্ডার মাহবুবুর রব সাদি’র কাছ থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রথম প্রেরণা লাভ করেন। যুদ্ধ করেছেন ৪ নম্বর সেক্টরে। যুদ্ধকালীন সেকশন কমান্ডার ছিলেন নুর আলম, সেকশন টুআইসি মির্জা জামাল পাশা। প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে বসির আহমেদ খুব দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। প্লাটুন টুআইসির দায়িত্ব পালন করতেন সাইদুর রহমান খান। যুদ্ধকালীন কোম্পানি-কমান্ডার ছিলেন নিজাম উদ্দিন। কোম্পানি টুআইসি ছিলেন হাদি গাজী। সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মাহবুবুর রব সাদি। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন চিত্তরঞ্জন দত্ত বা সি আর দত্ত।
ট্রেনিংয়ের জন্য তিনি ভারতের লোহারবন্ধ ও মালিধর অঞ্চলে যান। সেখানে প্রায় ৩০ দিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এসময় প্রশিক্ষক ছিলেন যথাক্রমে ক্যাপ্টেন চান ও রাজপুত রতিরাম। যুদ্ধের সময় গিয়াস উদ্দিন ছিলেন ১৬ বছরের কিশোর। বয়সে ছোটো হলেও তিনি ছিলেন বেশ উদ্যমী আর সাহসী। প্রশিক্ষণ শেষে মেঘালয়ের মালিডহর-এ শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন।
প্রশিক্ষণার্থীদের যোগ্যতা, ভাষার দক্ষতা ও সাহসিকতার ওপর ভিত্তি করে তাঁদের বিভিন্ন অস্ত্রের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। ডাক্তার গিয়াস উদ্দিন রাইফেল, ডিনামাইট, এন্টিটেইন প্রভৃতি বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন।
প্রশিক্ষণ শেষে তাঁর প্রথম অপারেশন ছিল জকিগঞ্জের রঘুরচক এলাকায়। এটি ছিল সম্মুখ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জালালপুরের আশরাফ আহমদ, আ. শুকুর, নুর আলম প্রমুখ। প্রায় ছয় মাস ধরে রঘুরচক-এ পাকিস্তানিদের সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা প্রায় শতাধিক। শহিদের সংখ্যা আনুমানিক ৬৯ জন। সর্বশেষ এ অভিযানে মর্টার ব্যবহার করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা।
তিনি বেশ কয়েকটি অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তন্মেধ্যে কানাইঘাটের লোভাছড়া, আটগ্রামের বড় বাড়ি, কালিগঞ্জের রাজাকার ক্যাম্প, কানাইঘাটের বিরাখাই এবং কানাইঘাট সদর উল্লেখযোগ্য।
লোভাছড়ার যুদ্ধটি ছিলো খুবই স্মরণীয়। এ অভিযানে তাঁকে বেশ কয়েকবার পেট্রোল এবং অ্যাম্বোসে বের হতে হয়ছে। এ যুদ্ধে তিনি তাঁদের একজন সহযোদ্ধা সালেহ আহমদকে হারান। তাঁর যুদ্ধকালীন সহযোদ্ধারা হলেন আলাউদ্দিন, শামস হাজী, আবদুর রব, জালাল উদ্দিন, বসির আহমদ, হোসিয়ার আলী, মীর্জা জামাল পাশা, শওকত প্রমুখ।
তাঁর দৃষ্টিতে সবচয়ে স্মরণীয় যুদ্ধ ছিলো আটগ্রাম অ্যাটাক। এ যুদ্ধে তাঁদের সহযোদ্ধা আলাউদ্দিন শহিদ হন। সেইসাথে শহিদ হন দুজন গুর্খা সৈন্য। এ যুদ্ধে তাঁদের দুর্বার আক্রমণে পাকিস্তানি মেজর আলবী নিহত হয়।
ডাক্তার গিয়াস উদ্দিন রঘুরচক ক্যাম্পবাড়ির লন্ডন প্রবাসী বসির আহমদের কন্যা রীনা বেগমের সাথে গাঁটছড়া বাধেন। রীনা বেগম তৎকালীন এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করে ইস্তফা দেন। বিয়ের সময় তাঁর বয়স ছিলো ১৮ বছর। ‘তালুকদার’ বংশে জন্মগ্রহণ করলেও মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস উদ্দিন কখনোই এ পদবি ব্যবহার করেননি।
ব্যক্তিজীবনে তিনি ৭ সন্তানের জনক। ছয় মেয়ে নাইমা, ফারহানা, মুন্নি, মেরিনা, এ্যানি এবং ছেলে রিয়াজুল ইসলাম জাবেদ। একজন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি সরকারের কাছ থেকে সম্মানি ভাতা গ্রহণ করছেন।
অবসরে তিনি ভ্রমণ করতেই বেশি পছন্দ করেন। বই পড়ার প্রতিও রয়েছে তাঁর ব্যাপক আগ্রহ। জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছেন ডাক্তারি। তিনি মনে করেন মানবসেবার জন্য এটিই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পেশা। পাশাপশি উপজেলা মানবাধিকার কমিশনেরও তিনি কার্যকরী সদস্য।
তাঁর স্বপ্ন ৯ নম্বর মানিকপুর ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধদের গণকবর একদিন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবে। কেননা এ গণকবরে মানিকপুর, বাল্লাহ, খলাদাপনিয়া, শহিদাবাদ, আনন্দুর, দরিয়াবাজ, সুলতানপুর, কাপনা, চারিগ্রাম, বেউরসহ দশগ্রামের মোট চৌদ্দজন মুক্তিযোদ্ধাকে সমাহিত করা হয়েছে। তিনি ৪ নম্বর সাব-সেক্টরের রঘুরচককে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিফলক হিসেবেও দেখতে চান।