লেখক হিসেব আমার অনুভূতি ও প্রতিবন্ধকতা
মুনশি আলিম

লেখকমাত্রই স্বপ্নদ্রষ্টা, আবেগপ্রবণ, আত্মপ্রত্যয়ী, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। শিক্ষকমÐলী যেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক তেমনি লেখকরাও সমাজের শিক্ষক। তবে অপ্রিয় সত্য এই যে, এই শিক্ষণ প্রক্রিয়া দুইভাবেই চলে। লেখকের কাছ থেকে পাঠক যেমন শিখে তেমনি পাঠকের কাছ থেকে লেখকও শিখেন। বাস্তবজীবন লেখককে দেয় ভিন্নধর্মী ব্যঞ্জনা। প্রাত্যহিক ঘটনার ঘনঘটা থেকে লেখক তুলে আনেন সাহিত্যরসদ। সাহিত্যেও প্রতিযোগিতা রয়েছে। বাজারে ব্যবসায়ীদের মধ্যে যেমন, খেলাধূলায় যেমন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেমন, তেমনি প্রতিযোগিতা রয়েছে লেখককের মধ্যেও। তবে এ প্রতিযোগিতার মুখ্যবিষয় সত্য ও সুন্দরের জয়গান।

একজন লেখক যত নিষ্ঠাবান হবেন ততই তার লেখনি নিখুঁত হবে। পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য যেমন পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই তেমনি আত্মপ্রতয়ী ও নিষ্ঠাবান লেখক হওয়ার জন্যও অধিক পঠনপাঠন ও পরিশ্রমের বিকল্প নেই। একজন প্রাতিষ্ঠনিক শিক্ষককে যেমন শিক্ষার্থীদের তুলনায় অধিক জ্ঞান রাখতে হয় তেমনি একজন গুণী লেখককেও সাধারাণ পাঠকদের থেকে অধিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হয়। আর জ্ঞান অর্জনে পরিশ্রমের বিকল্প নেই। ভালো লেখককে আগে ভালো পাঠক হতে হয়। সর্বজন স্বীকৃত প্রবাদÑভালো বীজ থেকে ভালো ফসল হয়। সেভাবে পড়–য়া ও পরিশ্রমী লেখকের মাধ্যমেও সৃষ্টিশীল কিছু করা সম্ভব হয়। একজন পাঠক যেখানে শুধু দর্শক, সেখানে প্রতয়ী লেখক শুধু দর্শক নন, পর্যবেক্ষকও বটে!

কষ্ট না করলে যে কেষ্ট মিলে না-এ তো সকলের জানা। তবে কথা থাকে যে কষ্ট করার সঠিক প্রক্রিয়াও জানতে হবে। তাহলেই অভিষ্ট লক্ষে পৌঁছা সম্ভব। লেখকবগর্কেও অভিষ্ট লক্ষে পৌঁছার জন্য চেষ্টা করতে হয়। করেনও। তবে সকলেই গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন না। গন্তব্যে পৌঁছতে না পারলে সমকালীন পাঠক যেমন মনে রাখে না তেমনি মহাকালও সে লেখককে ধরে রাখে না।

কথিত, মজনু-লায়লির জন্য পাগল হয়ে জনৈক সেজদারত নামাজির সম্মুখ দিয়ে দৌড়াচ্ছিলেন। পদশব্দে ধ্যান ভাঙ্গায় নামাজি ভদ্রলোক নামাজ থেকে দ্রæত উঠে মজনুকে থামালেন ও ভর্ৎসনা করলেন। প্রত্যুত্তরে মজনু শুধু বললেনÑআমি আমার লায়লির প্রেমে এতোই মশগুল যে, কোথায়, কার সম্মুখ দিয়ে যাচ্ছি সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। পৃথিবীর কোনো শব্দই আমার ধ্যান ভাঙ্গাতে পারেনি! লেখকদেরও তেমনি নিষ্ঠাবান হতে হয়। গভীর অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়েই একজন লেখক সত্যিকার লেখক হয়ে ওঠেন। সোনা পুড়ে যেমন মৌলিকত্ব লাভ করে তেমনি একজন লেখকও বাস্তবতার কাঠিন্যে নিজের চেতনাকে শান দিয়ে খাঁটি হয়ে ওঠেন।

প্রতিবছর নতুন বই বের হচ্ছে প্রায় কয়েক হাজার। তন্মধ্যে কাব্যের সংখ্যাই বেশি। আসলে জন্মগতভাবে প্রত্যেক মানুষই কবিসত্তা নিয়ে জন্মায়। এর প্রকাশ ঘটে শরীরে যখন যৌবনের গেরস্থালি শুরু হয়। তবে সকলেই তা ধরে রাখতে পারে না। কেউ তা কলম-খাতায় কাজে লাগায় আবার কেউ বা তা মৌখিকভাবে কাজে লাগায়। গান শিখা ও গান গাওয়া যেমন ধারাবাহিক সাধনার বিষয় তেমনি সাহিত্যের চাষবাস করাও মহাসাধনার বিষয়। যৌবনের এই ভাবাবেগকে সকলেই কাজে লাগাতে পারে না। যারা পারে, তারাই একসময় আলোচনায় উঠে আসে। খাঁটি নেতাদের যেমন মহাকাল শতাব্দীর পর শতাব্দী মনে রাখে তেমনি খাঁটি সাহিত্যিকদেরও। পাতি নেতারা মারা যায় সমকালেই তদ্রƒপ মৌসুমী লেখরাও। বছর বছর অসংখ্য বই বের হলেও তার সবগুলোই সাহিত্যের শিল্পরসে উত্তীর্ণ নয়। এর বেশিরভাগই থাকে অধ্যবসায়হীন মৌসুমী লেখকদের সৃষ্টি।
তথ্যপ্রযুক্তিতে একটি প্রবাদ রয়েছেÑআজকের প্রযুক্তি আগামী দিনের আবর্জনা! তবে কথা থাকে মৌলিক সৃষ্টির আবেদন চিরকাল। তা যেমন তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে তেমনি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও।

প্রাতিষ্ঠানিক বিষয় মেজর-ননমেজর। এই প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ের মতো সাহিত্যিকদেরও বর্তমানে রয়েছে দুটি দিক। অর্থাৎ সাহিত্যিকদেরও পাঠককুল দুইভাবে চিহ্নিত করেÑপ্রধান সাহিত্যিক ও অপ্রধান বা গৌণ সাহিত্যিক। প্রধান তারাই-যারা তাদের কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে সাহিত্যের প্রচলিত ধারার পরিবর্তন ঘটান। আর অপ্রধান সাহিত্যিকগণ প্রধানের অনুসারিত পথে হাঁটেন।

মৌলিক সৃষ্টির প্রত্যয় নিয়েই সাহিত্যে প্রবেশের চেষ্টা করেছিলাম। প্রবেশমুখেই প্রতিবন্ধকতা দেখা দিলোÑকোনো আদর্শ নিয়ে সামনে এগোচ্ছি কিনা! কোনো বিশেষ মতাদর্শীদের আদর্শ লালন করলে সেই গোষ্ঠীদের কৃপা মিলে খুব সহজেই। আর এ ধারা নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলেই অন্য মতাদর্শীরা বিরূপ দৃষ্টিতে দেখে। এ প্রভাব এখন শিল্পসাহিত্যের সব জায়গাতেই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। বিশেষ করে জাতীয় দৈনিকগুলোতে এ প্রভাব বেশি বিদ্যমান। সাহিত্যের ছোটোকাগজ যে একেবারে ধুয়া তুলসি তা কিন্তু নয়।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির মতো সব জায়গাতেই কেমন যেনো সিন্ডিকেট প্রকট হয়ে উঠছে। এ সিন্ডিকেট-গোষ্ঠীর আদর্শিকধারা বাঁচিয়ে রাখার জন্য। প্রচারের কিংবা প্রসারেরও। নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আজকাল সাহিত্যসৃষ্টি ও প্রচার-প্রসার বড়োই কঠিন হয়ে পড়ছে। পরিচিত বলয়ের বাইরে এই সিন্ডিকেটধারীরা অন্যদের প্রবেশকে অনুপ্রবেশ বলেই মনে করে!
সাহিত্যিকদের আজকাল দলীয় ছায়াতলে যাওয়ার প্রবণতাও গণহারে বেড়ে যাচ্ছে। তাতে সাহিত্যের মানের উন্নতি না ঘটলেও পরিচিতির যথেষ্ট উন্নতি ঘটে। একজন খাঁটি লেখক কখনোই সাময়িক পরিচিতির জন্য মুখিয়ে থাকেন না। তিনি যেমন নিজের তুষ্টির জন্য লেখেন তেমনি সমাজ পরিবর্তনের জন্যও। লেখালেখি একদিকে যেমন বিনোদনের জায়গা, আত্মতুষ্টির জায়গা তেমনি সামাজিক দায়বোধের জায়গাও। একজন প্রজ্ঞাবান লেখক যেমন নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারে না তেমনি পারে না সামাজিক দায়বোধকে এড়াতে।

সাহিত্য নিটোল বিনোদনের পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখে। কাজেই সেদিক থে

কে সাহিত্যকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার বললে বেশ একটা অত্যুক্তি হয় না।

যেভাবে সময়ের জটিল ক্যানভাস লেখককে করে তোলে বস্তুনিষ্ঠ আর আত্মপ্রত্যয়ী।

 

২৯.০৩.২০১৭

munshialim71@gmail.com

শিবগঞ্জ, সিলেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *