বারঠাকুরী নামকরণের ইতিকথা
মুনশি আলিম
সে অনেক দিন আগের কথা। তখনও বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। আমাদের এই বঙ্গভ‚মি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের অন্তর্ভুক্ত। আমাদের এই পূর্ববঙ্গ তখন কয়েকটি জনপদে বিভক্ত ছিল। যেমন : বঙ্গ, গৌড়, পুÐ্র, হরিকেল, সমতট, বরেন্দ্র প্রভৃতি। আমাদের এই সিলেট ছিল ‘হরিকেল’ জনপদের অন্তর্ভুক্ত। সিলেটের পরিধি ব্যাপক হওয়ায় জকিগঞ্জও তখন এর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
জকিগঞ্জের ঠিক পূর্ব দিকে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে রয়েছে সবুজ ঘাস, ফসলের সমারোহ, আর ছোটোবড়ো দিঘি। সবচেয়ে বড়ো দিঘির নাম নিয়েও রয়েছে কিংবদন্তি। জনশ্রুতি অনুসারে এই দিঘিকে বলা হয় ‘গায়েবি দিঘি’। এই দিঘির পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে ‘ত্রিমোহনা’। অর্থাৎ তিন নদীর মিলনস্থল।
স্থানীয় ভাষায় এর নাম ‘ত্রিগাঙ্গা’। এই ত্রিগাঙ্গা তথা নদীবিধৌত এ এলাকাকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে আশেপাশে অনেক বসতি গড়ে ওঠে। জনবসতি বাড়তেই সেখানে বিভিন্ন ধর্মপ্রচারকগণের বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। ইসলামধর্ম প্রচারকদের যেমন আনাগোনা ছিলো তেমনই ছিলো বৌদ্ধ ও হিন্দু পুরোহিতদের। গায়েবি দিঘিতে প্রাপ্ত বৌদ্ধমূর্তিই ধর্মপ্রচারকদের আনাগোনার প্রমাণ রাখে।
কথিত আছে, ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে এই অঞ্চলে বারোজন বৌদ্ধ ঠাকুরের আগমন ঘটে। বৌদ্ধধর্ম প্রচারই ছিল তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য যে, ‘ঠাকুর’ পদবি কেবল হিন্দুয়ানিই নয়; এটা একসময় মুসলিমরা এবং বৌদ্ধরাও গ্রহণ করত। ঠিক দেশবিভাগের আগে হিন্দু, মুসলিম সকলের নামের আগে যেভাবে ‘শ্রী’ লেখা হতো ঠিক তেমনই আর কী!
এই বারোজন ঠাকুর যখন কোনোদিকে যেতেন তখন তারা একসঙ্গে যেতেন। খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে ধর্মপ্রচার সকল কর্মই একসঙ্গে স¤পাদন করতেন। ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে তাদের বেশ প্রভাবও বাড়তে থাকে। এলাকার সাধারণ মানুষ তাদের কাছে বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক ও মানসিক সমস্যা নিয়ে হাজির হতো। উদ্দেশ্য এসব জটিল সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান। আর এই সুযোগগুলোই কাজে লাগানোর চেষ্টা করতো ঠাকুরবর্গ। একসময় কাকতালীয়ভাবেই এই এলাকায় আগমন ঘটে হয়রত শাহজালাল (র) এর শিষ্য হযরত সৈয়দ ইছে জালাল (র) ।
ইছে জালাল (র) ইসলামধর্ম প্রচার করতে গেলে বারো ঠাকুরদের সঙ্গে তাঁর তর্কযুদ্ধ হয়। দীর্ঘ তর্কযুদ্ধে ইছে জালাল (র) এর প্রখর যুক্তি আর বিচক্ষণতার কাছে হার মানে বারোজন ঠাকুর। শেষতক তারা হযরত ইছে জালাল (র)-কে গুরু বলে স্বীকার করে ইসলামধর্ম গ্রহণ করেন। হযরত ইছে জালাল (র) ও স্থানীয় এলাকাবাসী এই বারোজন ঠাকুরের ইসলামগ্রহণকে সম্মান জানালেন। এবং তাঁদের সম্মানার্থেই এই এলাকারই নামকরণ করেন বারোঠাকুর এলাকা। কালক্রমে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে কিছুটা বিকৃত হয়ে এই এলাকারই নাম একসময় হয়ে গেলো ‘বারঠাকুরী’।