ঘুরে এলাম কুমিল্লার ‘নগর শিশু উদ্যান’
মুনশি আলিম
নীলাভ আকাশ। সাদা মেঘের ভেলাগুলো আপন মনে ভাসছে। ক্লান্তিহীন, দূরে থেকে দূরান্তরে। অদূরেই কুমিল্লার নগর শিশু উদ্যান। কুমিল্লা বাংলাদেশের এক প্রান্তের সীমান্ত জেলা। প্রাচীন জনপদ। পূর্বনাম ছিল সমতট। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় ব্রহ্মপুত্র নদীর মুখে বঙ্গ জনপদের প্রতিবেশী জনপদ হিসেবে ছিল সমতটের অবস্থান। এ অঞ্চলটি ছিল আদ্র নিম্নভূমি। চৈনিক পরিব্রাজক ইউিয়েন সাং সমতটকে কামরূপের দক্ষিণে বিস্তৃত নিম্নদেশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বর্তমানে এ সমতট তথা কুমিল্লা হলো প্রাচীন ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। এখানকার জীবন-নদী, অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভ‚মি ও আকর্ষণীয় প্রত্নসম্পদের নিদর্শনে গড়ে উঠেছে এক ভিন্ন মাত্রার পরিবেশ।
ভ্রমণপিপাসু মানুষ এসব অপরূপ সৌন্দর্যের খুঁজে হন্যে হয়ে ছুটে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, শহর থেকে শহরতলিতে। নয়নকাড়া সৌন্দর্যের ঢালি দিয়ে সাজানো ‘নগর শিশু উদ্যান’। পরিকল্পনা, উদ্যোগ এবং বিনির্মাণ মহৎ হলে সে সৃষ্টি টিকে থাকে যুগের পর যুগ। এমনই একটি নান্দনিক বিনোদন কেন্দ্রের নাম কুমিল্লার ‘নগর শিশু উদ্যান’।
শহুরে ক্যানভাসে ঘেরা একটুকরো শিশুস্বর্গরাজ্য! চাকরিজীবীরা প্রতিনিয়তই এখানে আসে। শুধু কি চাকরিজীবী? শিশু উদ্যান শিশুদের উদ্দেশ্যে নির্মিত হলেও তা এখন শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, বয়স্ক নারীপুরুষদের দখলে। অদূরেই ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিনিসুতায় গাঁথা ধর্মসাগর। হ্যাঁ, আমি নগর শিশু উদ্যান সংশ্লিষ্ট কুমিল্লার ধর্মসাগরের কথাই বলছি।
শিল্পরসিকদের মতে, কুমিল্লা প্রাচীন স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক অঞ্চল। এখানে প্রাকৃতিক দৃশ্যের পাশাপাশি ঐতিহাসিক ঘটনারও সাক্ষী রয়েছে। বিনোদন পার্কগুলোতেও স্থাপন করা হয়েছে ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজরিত ম্যুরাল। অবসরে এসব উদ্যান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে।
শহরের চাকরিজীবীরা তাদের সন্তানসন্ততিদের নিয়ে এখানে আসে একটু স্বস্থির নিশ্বাস নিতে। উদ্যানটি শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় তাতে সংযোজিত হয়েছে বাহারি আধুনিক রাইডার। শিশুদের ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে উদ্যানে সংযোজন করা হয়েছে ভাষাশহিদদের ম্যুরাল। বিশেষ করে কুমিল্লার ভাষাশহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (২ নভেম্বর, ১৮৮৬Ñ২৯ মার্চ, ১৯৭১) স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ম্যুরাল। মূলত বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৯৭ সালে দেশের ‘সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার’ হিসাবে তাকে ‘ভাষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনে স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান করা হয়।
কুমিল্লা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক, বিশিষ্ট সংসদ সদস্য ও আইনজীবী হিসেবে শহিদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের নামে রাস্তার নামকরণ করে। জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে শহিদ খাজা নিজাম উদ্দিন সড়ক পর্যন্ত রাস্তাটি এখন থেকে শহিদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত সড়ক নামে পরিচিত। ১৮ জুলাই ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর জগন্নাথ হলে তাঁর নামে একটি ই-লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই নগর উদ্যানে এসে শিশু ও তাদের অভিভাবকগণ এই মহান ভাষাশহিদ সম্পর্কে পরিচিত হন। নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে পরিচয় করিয়ে দিতেই মূলত এই মহৎ উদ্যোগ।
শিশুদের শিল্পসাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে শিশু উদ্যানের মধ্যভাগে নামফলকের গায়ে লেপটে দেওয়া হয়েছে কবি আল মাহমুদের কবিতা।
ধর্মসাগরের উত্তরকোণে এই শিশুপার্ক। এই শিশুপার্কে বসে সাগরের দৃশ্য উপভোগ করা যায়। সবুজ-শ্যামল ও বিশাল বড়ো গাছ নিয়ে এই শিশুপার্ক। এই শিশুপার্কে বসলে মন ভরে যায় ভালো লাগার পরশে। রাজা ধর্মপালের নামানুসারে এই দিঘির নাম হয়েছে ধর্মসাগর। এটি সুবিশাল আয়তকার দিঘি। প্রায় ২০০-২৫০ বছর আগে আনুমানিক ১৭৫০ অথবা ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রজাহিতৈষী রাজা ছিলেন ধর্মপাল। তিনি ছিলেন পাল বংশের রাজা। বাংলায় তখন ছিল দুর্ভিক্ষ। রাজা দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সাহায্যের জন্য এই দিঘিটি খনন করেন। এই অঞ্চলের মানুষের জলের কষ্ট নিবারণ করাই ছিল রাজার মূল উদ্দেশ্য। এই দিঘিটি কেবল স্থানীয় মানুষের জলকষ্ট নিবারণ করছে, তা নয়। এই দিঘিই ভ্রমণকারীদের মনকে ছুঁয়ে যায় মনোমুগ্ধকর কাল্পনিক এক ভালোলাগার পরশে।
কুমিল্লা নগর শিশু উদ্যানে চালু হয়েছে মহানগর এক্সপ্রেস ট্রেন। সুন্দর এই ট্রেনটিতে প্রায় ৪০ জন শিশু ধারণ ক্ষমতা স¤পন্ন ৪টি বগি রয়েছে। ২ চক্কর চলবে। এই ট্রেনটিতে জনপ্রতি টিকেট মাত্র ৩০টাকা। নগর উদ্যানে স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল। মুক্তিযুদ্ধ, দেশেপ্রেম তথা বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করে দেওয়ার জন্যই এই মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অনিন্দ্যসুন্দর এই পার্কটি ৫ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। এর উত্তর-পূর্ব কোণে রয়েছে রানি কুটির এবং একটি শিশু পার্ক ও নজরুল একাডেমি। ধর্মসাগরে আপনি নৌকায়ও ভ্রমণ করতে পারবেন।
ভোর থেকেই শুরু হয় ভ্রমণপিপাসুদের আনাগোনা। তবে জনসমাগম বেশি হয় বিকেলবেলায়। চাকরিজীবীরা অফিস শেষে তাদের সন্তানদের নিয়ে আসে। শিশুরা উদ্যানে বিভিন্ন প্রাণী বিশেষ করে হাতি, বাঘ, গÐার, জিরাফ, সিংহ, মোরগ প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়। এছাড়াও রয়েছে চিত্তাকর্ষক কার্টুন ভাস্কর্য।
ওয়াটার ড্যান্স থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাইডারে চড়ে শিশুরা হারিয়ে যায় আনন্দের স্বর্গরাজ্যে। শিশুদের খুশিতে অভিভাবকদের মনেও অদ্ভুত ভালোলাগার শিহরন ঢেউ খেলে যায়। সত্যি, ছবির মতোই সুন্দর কুমিল্লার ‘নগর শিশু উদ্যান’। এ পার্কে এলে যেকোনো ভ্রমণপিপাসুর চোখ জুড়িয়ে যাবে, হৃদয় পূর্ণতায় সিক্ত হবে।