বই আলোচনা
মুনশি আলিম
কবি মাজহার মোশাররফের ইনসমনিয়া একটি নিটোল কাব্য। প্রথমেই আসা যাক ইনসমনিয়া কী সে প্রসঙ্গে। ইংরেজি insomnia শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ অনিদ্রা; নিদ্রাহীনতা; অনিদ্রারোগ। জাগতিক বিষয়ের বিচ্যুতিতে বোধের উলম্ফনকেই এখানে ইনসমনিয়ারূপে গণ্য করা হয়েছে। তবে এ নামকরণের ক্ষেত্রে কবিসত্তার অস্তিত্ববাদিতা এবং রিয়ালিজম উভয়ই জড়িত।
ইনসমনিয়া কাব্যটি ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়। কাব্যটিতে মন্ময় এবং তন্ময় উভয় প্রকার কবিতারই সন্নিবেশ রয়েছে। তবে শুরুটা হয়েছে তন্ময় কবিতা দিয়ে। সুভাস মুখোপাধ্যায়ের পদাতিক কাব্যটি যেমন শুরু হয়েছিল তন্ময় কবিতা দিয়ে ঠিক তেমনই। তবে কবি মাজহার মোশাররফ তাঁর ইনসমনিয়া কাব্যে একধারা অক্ষুণ্ণ রাখেননি। ৫ ফর্মার এই কাব্যটি প্রকাশিত হয়েছে চৈতন্য থেকে। কাব্যটিতে মোট কবিতা আছে ৭২টি। প্রতিটি কবিতারই ভাব, বিষয়বস্তু এবং প্রকরণও ভিন্ন। তবে পুরো কাব্যটিই গদ্যছন্দে লেখা।
ইনসমনিয়া কাব্যের ভাষা যেমন সরল তেমনই প্রাঞ্জল। ভাষার সরলীকরণের ক্ষেত্রে এটি অন্যতম উদাহরণ হিসেবে টানা যেতে পারে। টিনএজার থেকে বোদ্ধাপাঠক সকলের কাছেই কাব্যভাষা আকৃষ্টকর হবে বলেই আমার বিশ্বাস। তাঁর কাব্যে মেহেদী গাছ, মাছি, প্রজাপতি, নদী, নারী থেকে শুরু করে দেশীয় রাজনীতির নগ্ন ক্যানভাস, অর্থনীতির রুগ্ন পরিবেশ, দুর্নীতির ভয়াল চিত্র বিশেষ ব্যঞ্জনায় ফুটে ওঠেছে।
কবি মাজহার মোশাররফ শব্দকে শিল্প করে তুলতে যেমন সিদ্ধহস্থ তেমনই সিদ্ধহস্থ দৃষ্টিকটু বিষয়কে রঙ্গ-ব্যাঙ্গের মাধ্যমে আয়নার মতো করে চোখের সামনে তুলে ধরতে। ইতিহাসের আলোকে আমরা দেখি প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থার শ্রেণিবৈষম্য। যুগে যুগে এ বৈষম্যের কেবল রূপের বদল ঘটে, যেভাবে বদল ঘটে শাসকের। তিনি একধরনের ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপের বান ছুড়ে মেরেছেন সমাজের শাসক শ্রেণির প্রচলিত রাজনীতির প্রতি। তবে ব্যবহার করেছেন কাব্যিক উপমা বা যুতসই চিত্রকল্প। তাঁর কাব্যভাষায়—
মাছির চেয়ে বেহায়া আর কে আছে?
এরশাদ যদিও আছে।
তাদের নেই কোনো স্থান, কাল, পাত্রের ভেদ
তারা ওড়ে এসে বসে পড়ে
লেগে থাকে
মারা যে পড়ে না তাও নয়
তবু তারা আসে।
গুড় ও বিষ্ঠা-দুটোতেই বসে।
হায় এ পোড়া দেশে মানুষেরা জন্মের পর মাছি হয়ে যায়। (মোশারফ, ২০১৫ : ১১)
তাঁর কবিতার প্রজাপতিরা হয়ে উঠেছে বৈষ্ণব কবিতার মতোই চিরায়ত, অতি পরিচিত আর সেইসঙ্গে প্রতীকী তো বটেই। দার্শনিক কবিতায় প্রথম মন্ময় কবিসত্তার স্ফুরণ ঘটে। এটা অনেকটা মেঘের আড়াল থেকে হঠাৎ সূর্যের উঁকি দেওয়ার মতো ঘটনা। ইনসমনিয়া কাব্যের অনেক কবিতাই পাঠককে নানাভাবে আকৃষ্ট করতে পারে। এমনই একটি কবিতা হলো শৈশবে বাঁচি।
[…] আমার ভিতর এক অনন্ত শৈশব
আমি শুধু সেই শেশবে বাঁচি। (মোশারফ, ২০১৫ : ১৭)
কবি মাজহার মোশাররফের কবিতায় যেমন আছে দেশপ্রেমের চেতনা, যেমন আছে দেশীয় অস্থিরতার চিত্র তেমনই আছে মন্ময় হতাশার সমুদ্রে অবগান। অবশ্য আশা কিংবা হতাশা কাব্যেরই একটি মৌলিক অংশ।
সব কবির সব কবিতাই কি হৃদয় ছুঁয়ে যায়? না, যায় না। তবে কোনো কবিতা যদি জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে হৃদয় ছুঁয়ে যায়। যদি ছুঁয়ে যায় তবেই বুঝতে হবে সে কবিতা সার্থক, কবি তো বটেই। ইনসমনিয়া কাব্যের অনেক চিত্রকল্পই পাঠকের মনে ধরার মতো। পাঠক অবলীলায় এ চিত্রকল্পগুলোর বাঁকে বাঁকে নিজের অস্থিত্বকে খুঁজে পাবে, নিজের ভালোলাগাকে খুঁজে পাবে, নিজের মগ্নতাকে খুঁজে পাবে। পাঠকের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মিথস্ক্রিয়াও ঘটবে। এমনই একটি কবিতা—
নদীর উপর লোহার সাঁকো
তার শরীরের ভিতর ছোটো ছোটো আলোর বিন্দু
অন্ধকারে কালো রেখার স্রোত।
আমি দূর থেকে দেখি।
কনক্রিটের খোলসের পছনে (?) লাজুক আকাশ রঙ বদলায়
ধীরে স্থির পায়ে শীতের কুয়াশা এসে নামে। [মোশাররফ, ২০১৫:৩৬]
কোনো কোনো কবিতায় উঠে এসেছে সুচিত্র সেনের প্রতি অনুরক্ততার সুর। আবার কোনো কোনো কবিতায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন রিয়ালিজম। মোদ্দাকথা, তাঁর অধিকাংশ কবিতাই চিন্তার খোরাক জোগাবে বলেই আমার বিশ্বাস।
স্রষ্টার সৃষ্টির মধ্যে মানুষ হলো সবচেয়ে রহস্যময়। আবার মানুষই হলো সবচেয়ে পরিবর্তনশীল। বিশেষ করে ক্রোধই মানুষকে তার সত্তা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। প্রযুক্তির এ যুগে মানুষ যেনো আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। মানবসত্তা যেনো আরও প্রগলব হয়ে ওঠছে। এককথায় বলতে হয়—আধুনিকতার যাতাকলে মানুষের ক্রোধের নগ্ন চিত্রই তাঁর ক্রোধ কবিতায় স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠেছে।
[…] কি (?) এক নিদারুণ অস্থিরতা পেয়েছে আজকাল
সকলেই রেগে যায়
কারণে অকারণে
ক্রোধের চেয়ে বন্য কোনও ভাব মানুষের নেই।
সূর্যের ক্রোধ নেই, পাহাড়ের ক্রোধ নেই, বৃক্ষের ক্রোধ নেই।
মানুষের এত ক্রোধ কেন? [মোশাররফ, ২০১৫:৩৬]
তাঁর কাব্যের বৈশিষ্ট্য ঠিক তাঁরই মতো স্বতন্ত্র। এককথায় কবির কাব্যপাঠে যে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে ফুঠে ওঠেছে, সেগুলো হলো— সমকালীন বাস্তবতা, রঙ্গব্যাঙ্গ, ইতিহাস-ঐতিহ্যতা, প্রেম, প্রকৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, মানবিকতা, বৈশ্বিক জটিলতা, দেশপ্রেম, শ্রেণি বৈষম্য, বিবিধ। ইনসমনিয়া কাব্যের ভাষার সরলীকরণের ক্ষেত্রেও তিনি বিশেষভাবে কৃতিত্বের দাবিদার। উপমাগুলোও তার কবিতায় লেপটে থাকে কাব্য শরীর হয়ে, শব্দ শরীর নয়। তবে কবিতাগুলোর সন্নিবেশ প্রাক্কালে কেবল মন্ময় কবিতা অথবা কেবল তন্ময় কবিতা হলে কাব্যটি ভিন্নমাত্রাও হয়ত পেতে পারত।
কবি মাজহার মোশাররফ কবিতার এক নিবেদিত প্রাণ। তিনি মূলত কবি। কবিতাই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। তাঁর কবিতার ভাঁজে ভাঁজে ভাষার সরলীকরণ যেমন চোখে পড়ার মতো তেমনই শব্দালংকারও দৃষ্টি কেড়ে নেওয়ার মতো। সর্বোপরি ভাব-ভাষা ও বিষয়-বস্তুর নতুনত্বে ‘ইনসমনিয়া’ পাঠক হৃদয়ে অবলীলায় প্রভাব বিস্তার করবে বলেই আমার বিশ্বাস।